
ঢাকার একটি কলেজের মার্কেটিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র হৃদয় আহম্মেদ (২৩)। করোনার এই সংকটকালে তার মতো তরুণেরা যখন অসহায় মানুষের পাশে থাকছেন, তখন তিনি উল্টো ফাঁদ পেতেছেন। আক্রান্তদের পাশে থাকা তো দূরের কথা, তিনি করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্লাজমা (রক্ত রস) নিয়েই রোগীর স্বজনদের সঙ্গে শুরু করেন বেইমানি! প্লাজমা ‘দানের’ ফাঁদ পেতে রোগীদের স্বজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন নগদ টাকা।
অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি এই প্লাজমা প্রতারকের। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্লাজমা দানের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কাহিনী বলেছেন তিনি। হৃদয় বলেছেন, মজা করে মোবাইল ফোন থেকে ফেসবুক গ্রুপে প্লাজমা দানের ঘোষণা দেন তিনি। এরপর দেখেন, প্লাজমা পাওয়ার জন্য অনেকে ফোন দিচ্ছেন, যতো টাকা লাগে দিতে চাচ্ছেন। এতে লোভে পড়ে যান।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। শুক্রবার তাকে আদালতে হাজির করলে তিনি প্লাজমা প্রতারণার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন।
ওই প্রতারককে গ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ডিবির তেজগাঁও জোনের সহকারী কমিশনার মুজিব আহম্মদ পাটওয়ারী সমকালকে বলেন, ফেসবুকে গড়ে ওঠা প্লাজমা ব্যাংকগুলো থেকে প্লাজমা লাগবে এমন রোগীর স্বজনদের নম্বর সংগ্রহ করতেন হৃদয়। আবার ওই গ্রুপগুলোতে প্লাজমা দানের কথা বলে নিজের নম্বর দিয়ে দিতেন। লোকজন তখন ফোন দিলে তিনি যাতায়াত ভাড়ার জন্য টাকা দাবি করতেন। রোগীর স্বজন ধনাঢ্য বুঝতে পারলে বেশি টাকা দাবি করতেন। এভাবে রোগীর স্বজনরা যোগাযোগ করে তার মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা নিয়ে নম্বরটি ব্লক করে দিতেন।
ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, এর আগে শরীফ নামে প্লাজমা প্রতারক চক্রের একজন সদস্যকে ধরেছিলেন। ওই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে হৃদয়ের সন্ধান মেলে। সে স্বীকার করেছে, রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে প্লাজমা দেওয়ার কথা বলে এক থেকে তিন হাজার করে টাকা নিতো। এভাবে ১০ থেকে ১২ জনের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
মেধাবী ছাত্র থেকে যেভাবে প্লাজমা প্রতারক হৃদয় : শুক্রবার আদালতে দেওয়া জবানবন্দি ও ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারণার জগতে পা দেওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন হৃদয়। বলেছেন, শুরুর দিকে মজা করে তিনি প্লাজমাদাতা হিসেবে ফেসবুকে পোস্ট দেন। এরপর দেখেন প্লাজমার ব্যাপক চাহিদা। লোকজন টাকা দিয়েও প্লাজমা নিতে চায়। তখনই লোভে পড়ে যান তিনি।
হৃদয় বলেন, তার বাবা বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী ছিলেন। কয়েক মাস আগে তার ওপেন হার্ট সার্জারি করাতে হয়েছে। এজন্য নিজের পড়ালেখার খরচ চালাতে পারছিলেন না, হাত খরচও ছিল না তার। নগদ টাকার গন্ধ পেয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন তিনি।
হৃদয় দাবি করেছেন, লোকজনকে না করলেও তারা অনুরোধ করতেন প্লাজমার জন্য, অগ্রিম টাকা পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু তিনি তো করোনা আক্রান্ত হননি, প্লাজমা পাবেন কোথায়। এই বোধ হওয়ার তিনি নিজের মোবাইলও বন্ধ করে দেন। প্রতারণার টাকা দিয়ে শিক্ষকদের টিউশন ফির বকেয়া টাকা দিয়েছেন। বন্ধুদের দেনা পরিশোধ করেছেন।
ডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, হৃদয় ধরা পড়ার আগেই তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। তার বাবা-মাকে বিষয়টি বলার পর তাকে তারা মারধর করেন। কিন্তু টাকার লোভে একই অপকর্ম করছিলেন তিনি।
চিকিৎসকদের উদ্ধৃত করে ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা আক্রান্ত হয়ে কোনো ব্যক্তি সুস্থ হলে তার দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। সুস্থ ওই ব্যক্তির দেহ থেকে প্লাজমা (রক্ত রস) সংগ্রহ করে মুমূর্ষু করোনা রোগীর দেহে তা প্রয়োগ করলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ জন্য চিকিৎসকদের পরামর্শে মুমূর্ষু রোগীর স্বজনরা সুস্থ ব্যক্তির কাছ থেকে প্লাজমা সংগ্রহের জন্য নানা মাধ্যমে চেষ্টা চালান। স্বজনদের এই অসহায় অবস্থাটা পুঁজি করে প্রতারক চক্র টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফাঁদ পেতে বসেছে।